-আলহাজ্ব এম.এ.কাদের
দীর্ঘমেয়াদি পোল্ট্রি শিল্পে লোকসান ও সর্বশেষ করোনা ভাইরাসের ধাক্কা সামলে উঠতে না পেরে দেশের অধিকাংশ কমার্শিয়াল ফার্ম ও ব্রয়লার বাচ্চা উৎপাদনকারী হ্যাচারীগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের দেশে পোল্ট্রি শিল্প ৮০’র দশকে শুরু হলেও মুলতঃ ২০০০ সালের পর থেকে এর বিস্তার লাভ করে। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ তাদের প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করে থাকে মুরগীর মাংশ দিয়েই। উন্নত বিশ্ব যেমন কানাডা, জাপান, আমেরিকা, মালয়েশিয়া একজন মানুষ গড়ে বছরে মুরগীর মাংশ খায় ৪০-৪৫ কেজি পর্যন্ত। সেখানে আমাদের দেশে প্রতিজন খায় মাত্র ৪-৫ কেজি। সরকার দেশে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ ও বেকার সমস্যা দূরীকরণে পোল্ট্রি শিল্প বিস্তার লাভের জন্য রাজস্ব আয়ের বাইরে রেখেছেন। সরকারের এই উদ্দ্যোগ বর্তমান দেশে প্রায় ৭০-৮০টি ব্রয়লার ও লেয়ার হ্যচারী গড়ে উঠেছে।
দেশে প্রতিদিন ব্রয়লার বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ২৩ লক্ষ পিচ। ব্রয়লার মুরগী উৎপাদন শুরু হওয়ার পর থেকে গত ২০ বছরে মুরগীর দাম প্রতিকেজি ৮০-১২০ টাকা দরের মধ্যে আছে। যেখানে গরুর মাংশ ৬শত টাকা, খাশীর মাংশ ৮শত টাকা। গত ২০ বছরে সব জিনিসের মূল্য ৫-৭গুন বাড়লেও, মুরগীর দাম বাড়ে নাই। ২০০০ সালের পর থেকে এ শিল্পের সাথে জড়িত প্রায় দেড় কোটি মানুষ লাভ-লোকসানের মধ্যে দিয়ে কোন রকম টিকে ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে পোল্ট্রির মাংশ নিয়ে বিভিন্ন রকম অপপ্রচার ও দেশে বিদেশী কোম্পানীগুলোর অধিক উৎপাদনের কারনে, গত ২০১৭ সালের জুলাই থেকে একটানা লোকসানে পড়ে পোল্ট্রি ফার্ম ও হ্যাচারীগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। হ্যাচারীগুলোর ব্রয়লার মূরগীর বাচ্চার উৎপাদন খরচ, প্রতি পিচ ৩২-৩৫ টাকা হলেও গত ৩ বছর যাবৎ একটানা প্রতিটি বাচ্চা বিক্রয় হয়েছে মাত্র ৫-২০ টাকার মধ্যে। এতে করে হ্যাচারীগুলো প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকা লোকসান দিয়েও সামনে লাভের আসায় উৎপাদন ধরে রাখার চেষ্টায় ছিল। ব্রয়লার মুরগীর মাংশ উৎপাদন খরচ প্রতিকেজি ১২০ টাকা হলেও বিক্রয় হয়ে আসছে মাত্র ৮০-১০০ টাকার মধ্যে।
ব্রয়লার মুরগী উৎপাদনকারী কমার্শিয়াল ফার্মগুলো উৎপাদন বন্ধ করে পথে বসেছে। দেশে ব্রয়লারবাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হ্যাচারীগুলো দীর্ঘদিন লোকসানের কারনে ব্যাংক ও পাবলিক ঋণ বৃদ্ধি পেয়ে ইতিমধ্যে বেশ কিছু বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাকি কিছু হ্যাচারী চলতি মার্চ/এপ্রিলে ব্রয়লারবাচ্চার দাম বেশি পাবে এই আশায় তাদের সর্বস্ব বিনিয়োগ করে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। এর মধ্যে অশনি সংকেত মহামারী করোনা ভাইরাস ৮মার্চ দেশে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রভাব পড়ে পোল্ট্রি শিল্পে। দেশে করোনা ভাইরাস ছড়াতে না পারে, আমরা যখন সবাই সতর্কতা অবলম্বন করছি, তখনই প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে গুজব শোনা গেল মুরগীর থেকে ভাইরাস ছড়াচ্ছে।এ কারনে মুরগীর মাংশ কেউ খাচ্ছেন না। এই গুজব আমাদের দেশে ছড়িয়ে পড়ায় হ্যাচারীতে উৎপাদিত কোটি কোটি টাকার লক্ষ লক্ষ পিচ এক দিনের বাচ্চা কোন ডিলার, খামারী না নেওয়ায় মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। তাছাড়া করোনা ভাইরাস নিয়ে সতর্কতা বাণীর মধ্যে পশু পাখি থেকে দুরে থাকার কথা প্রচার করা হয়। এ জন্য বেশির ভাগ শ্রমিক কাজ বন্ধ করে দেয়। এই সময় কোন মুল্যেই মুরগীর বাচ্চা বিক্রয় না হওয়ায় টাকার অভাবে মহাসংকটে পড়ে হ্যাচারী মালিকরা। মুরগীর খাবার ক্রয়, শ্রমিকদের বেতন, বিদ্যুৎ বিল, ব্যাংক কিস্তি ,পাবলিক দেনার চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। হ্যাচারী থেকে বাচ্চা ফোটানোর ধারাবাহিকতা অনুযায়ী ইনকিউবেটরে থাকা কোটি কোটি টাকার (ডিম ফোটার অপেক্ষায়) লক্ষ লক্ষ ডিম মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়।
উৎপাদনে থাকা প্যারেন্টস মুরগীগুলো খাদ্যের অভাবে মারা যেতে থাকে। লগ্নীকারী ব্যাংকগুলো কাছে শুধু খাদ্য ক্রয়ের জন্য বার বার ধর্ণা দিয়ে অনুনয় বিনয় করেও কোন সাহায্য পাওয়া যায়নি। ১ দিনের ব্রয়লার প্যারেন্টস বাচ্চা কোম্পানীর নিকট থেকে তিনশত টাকা দরে খরিদ করার পর ৬ মাস যাবৎ খাদ্য, ঔষধ, ভ্যাকসিন লালন পালন করে উৎপাদন শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিটি মুরগী তৈরি করতে খরচ পড়ে ১হাজার ৬শত টাকা থেকে ১ হাজার ৮শত টাকা। অর্থের অভাবে ঐ মুরগী মাত্র ২ শত টাকা থেকে ২ শত ৫০ টাকায় বিক্রয় করে বেঁচে থাকার কিছু মুরগীর খাদ্য সরবরাহ করা হয়। এই অবস্থায় দ্রুত পরিবর্তন না হলে ব্যাংক ঋণ বা সরকারী সাহায্য সহজে পাওয়া না গেলে অচিরেই দেশের ৯৫ ভাগ হ্যাচারীই বন্ধ হয়ে যাবে। ইউনিভার্স্যাল পোল্ট্রি হ্যাচারীজ লিঃ-এর একজন পরিচালক দুঃখ-ক্ষোভে জানান, দেশের প্রথম শ্রেণীর একটি বেসরকারী ব্যাংক থেকে মাত্র ১১ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে এ পর্যন্ত ব্যাংকে লাভ দিয়েছি প্রায় ১০ কোটি টাকা। ব্যাংকের সাথে লেনদেন নিয়মিত থাকা সত্বেও মুরগীগুলোর জীবন বাঁচানোর জন্য বার বার ধর্ণা দিয়েও ন্যুনতম সাহায্য পাওয়া যায়নি।
মৃত প্রায় এই কঠিন সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে (প্রাণী সম্পদ) অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অনিয়ন্ত্রিত পোল্ট্রি শিল্পকে শৃংখলার মধ্যে আনতে হবে। যে কোন মূল্য পোল্ট্রি মাংশ নিয়ে অপপ্রচার বন্ধ করতে হবে। আর যদি পোল্ট্রির মাংশ খেলে ক্ষতির কিছু থাকে, তাহলে এটা একেবারেই বন্ধ করে দিতে হবে। বা কোন অসাধু ব্যবসায়ী খাবারের সাথে ক্ষতিকর কিছু মেশালে তাকে কঠিন শাস্তির বিধান রাখতে হবে। সারা বিশ্ব যেখানে পোল্ট্রির মাংশের উপর নির্ভরশীল সেখানে যত অপপ্রচার বাংলাদেশে। তাছাড়া চাহিদার তুলনায় উৎপাদন অনেক বেশির হওয়ায়, বিদেশী যে সমস্ত বড় বড় কোম্পানী (মুরগীর ফার্ম) আমাদের দেশে জেঁকে বসেছে, সে গুলোকে বন্ধ করে দিতে হবে। দেশের বড় বড় বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গুলোকে অবশ্যই শৃংখলার মধ্যে এনে বাচ্চা উৎপাদন কমিয়ে রাখতে হবে। চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন রাখতে হবে অথবা উৎপাদনের সাথে সাথে মিল রেখে মুরগীর মাংস বিদেশে রপ্তানী করতে হবে। হ্যাচারীর উৎপাদিত ব্রয়লার বাচ্চার মূল্য কমপক্ষে ৪০ টাকা থেকে ৫০ টাকা এবং উৎপাদিত মুরগী প্রতিকেজি কমপক্ষে ১৫০ টাকা থেকে ১৬০ টাকা করতে হবে। দেশের মানুষের মুরগীর মাংস খাওয়ার উপকারীতা সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে পাঠ্যপুস্তক, সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক্ মিডিয়ায় জোর প্রচার করতে হবে। শুধু রান্না করে খাওয়া নয়, উন্নত দেশের মত বিভিন্ন খাবারের সাথে মুরগীর মাংস সংযুক্ত করে দেশে-বিদেশে রপ্তানী করতে হবে। বিদেশ থেকে রোগাক্রান্ত, রোগ সৃষ্টিকারী গরু আমদানী বন্ধ করতে হবে।
যে সমস্ত মিডিয়া মুরগীর মাংস নিয়ে অপপ্রচার চালায়, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। হ্যাচারীগুলো ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য বিনা লাভে অথবা কম লাভে ছোট ছোট হ্যাচারীদের ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। মুরগী উৎপাদন কৃষিভিত্তিক বিধায়, বিদ্যুৎ বিল কমায়ে কৃষি ভিত্তিক করতে হবে। মুরগী এবং বাচ্চা উৎপাদনের জন্য খাদ্য উপাদান, মেডিসিন ও ভ্যাকসিনের দাম কমাতে এবং নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। হ্যাচারী (বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান) আশ-পাশে কমপক্ষে ১ কিঃ মিঃ এর মধ্যে কেউ হাঁস-মুরগী, পাখি জাতীয় প্রাণী পালন করতে না পারে এর জন্য নিয়মনীতি থাকতে হবে। প্রত্যেক উপজেলায় রোগ নির্ণয়ের জন্য উন্নত মানের ল্যাবরেটরী ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ দিতে হবে। একদিনের উৎপাদিত মুরগীর বাচ্চা দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবহনের জন্য ফেরীঘাটে জরুরী ভিত্তিতে পারাপারের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের বেকার সমস্যা দূরীকরণে পোল্ট্রি শিল্পকে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি করে বিদেশে রপ্তানী করলে এই শিল্প প্রসারের সাথে সাথে অনেকাংশ বেকার সমস্যা দূর করা সহ প্রচুর পরিমানে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
এছাড়া মুরগির বিষ্ঠা জৈব সার হিসাবে ব্যবহার করে ফসলের ফলন বৃদ্ধির পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে বিদেশ থেকে রাসায়নিক সার আমদানি অনেকাংশ কমানো সম্ভব। এ শিল্পকে অবহেলার চোখে না দেখে, সরকারের এগিয়ে এসে সু-পরিকল্পিতভাবে পোল্ট্রিনীতি বাস্তবায়ন করে মৃত প্রায় এই শিল্পকে বাঁচিয়ে, বেকার সমস্যাদূরসহ দেশের প্রোটিনের চাহিদা মিটিয়ে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ একান্ত কাম্য।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিষ্ট