কৃষিবিদ মোঃ মোরশেদ আলম , সভাপতি, বাংলাদেশ এনিমেল এগ্রিকালচার সোসাইটি (BAAS);
প্রাক্তন মহাসচিব, এনিমেল হেলথ কোম্পানীজ এসোশিয়েশন অফ বাংলাদেশ ( AHCAB) ও প্রাক্তন সহ-সভাপতি, ওয়ার্ল্ডস' পোল্ট্রি সায়েন্স এসোশিয়েশন বাংলাদেশ শাখা (WPSA-BB)
বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পের শুরু খুব বেশী দিনের না। দেশের স্বল্পমূল্যে উন্নতমানের প্রোটিনের বৃহত্তম খাত, যা মাটি ও মানুষের শিল্প। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ৫০-৬০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা এ খাতের ওপর নির্ভরশীল। নব্বই দশকের শুরুতে পোল্ট্রি শিল্প একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্পে রূপ নিতে থাকে। হাতে বানানো খাদ্য (ফিড) দিয়ে শুরু হলেও নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে কমার্শিয়াল ফিড যাত্রা শুরু করে। এই শিল্পের উত্থানে তৎকালীন একমাত্র সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশন (BPICC) এর অবদান না বললেই নয়। দেশে থেকেই উন্নত খামার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতে আয়োজিত হয় বিশ্বমানের মেলা ও সেমিনার। নতুন মিলেনিয়ামে প্রবেশ পর্যন্ত বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পের প্রবৃদ্ধি ছিল বছরে প্রায় ১০-১৫% হারে। ধীরে ধীরে নিজের শক্ত ভিত্তি তৈরী করে ফেলেছে এই শিল্প। ঠিক তখনই আসে প্রথম ধাক্কা।
২০০২ সালে কিছু অতি উৎসাহী ও অপরিপক্ক চিন্তাধারার গবেষক আর কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন গণমাধ্যম প্রচারণা শুরু করে পোল্ট্রি ফিডের উপাদান যেমন ভুট্টায় আফলাটক্সিন আছে, যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর। ধস নামে পোল্ট্রি শিল্পে, পথে বসে হাজার হাজার খামারি, বন্ধ হয়ে যায় খামার। ২০০৪-এ সারা বিশ্বে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রাদুর্ভাব ঘটে, গণমাধ্যম সৃষ্টি করে এক ভীতিকর অবস্থা। জনমনে ডিম ও মুরগীর মাংসের প্রতি আতংক, যদিও তখন বাংলাদেশের পোল্ট্রি এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা মুক্ত। ব্যস, আবার ধস পোলট্রি শিল্পে, এক সপ্তাহেই ক্ষতি শত কোটি টাকা! বেকার খামারি। পালিয়ে বেড়ায় ব্যাংক ঋনের বোঝা মাথায় নিয়ে। পোল্ট্রি শিল্পের সংগঠনগুলি একত্রে বসলো কিভাবে এ ধরনের দূর্যোগ সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করা যায়।
২০০৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে তৎকালীন ৫ টি সংগঠনের সম্মতিতে গঠিত হলো, 'বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ কো-অর্ডিনেশন কমিটি' সংক্ষেপে বি পি আই সি সি (BPICC)। বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনা-পর্যালোচনা এবং নানা কৌশলে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হলো। ২০০৭-এ প্রথম এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার আবির্ভাব হয় বাংলাদেশে, বিশ্ব মোড়লদের পরামর্শে ধ্বংস করা হয় লাখ লাখ মুরগী, ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে থাকে অসহায় পোল্ট্রি শিল্প। পরবর্তীতে ট্যানারি বর্জ্য, এন্টিবায়োটিক এ সব ইস্যুতে গুজব, জ্ঞানপাপীদের ব্যক্তিস্বার্থে কান্ডজ্ঞানহীন বক্তব্য আর গণমাধ্যমের বিভ্রান্তিকর সংবাদ পরিবেশনায় একের পর এক ধাক্কা আসতে থাকে যা খাদের কিনারায় নিয়ে ফেলে পোল্ট্রি শিল্পকে! পোল্ট্রি শিল্প আজ ৫০-৬০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের খাত।
বর্তমানে দিনে ৩০ লাখ একদিনের বাচ্চা, বছরে ৫০-৬০ লাখ মেট্রিক টন ফিড, দিনে ৩-৪ কোটি ডিম, দেশের মোট মাংসের ৪০% উৎপাদন করে এই শিল্প। ১৬টি গ্রান্ড প্যারেন্ট স্টক, ২০৬টি পোল্ট্রি হ্যাচারী, ১৯৮টি ফিড মিল, ৬০-৭০ হাজার কমার্শিয়াল খামার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল এদেশের মানুষের জন্য সাশয়ীমূল্যে উন্নতমানের আমিষ সরবরাহ করার। ২০২০ সালের শুরুতেই হাজির নতুন বিপদ করোনা ভাইরাস। আবার মুখ থুবড়ে পড়লো পোল্ট্রি শিল্প, মার্চের ২১ দিনেই ক্ষতি ১,২৭৫ কোটি টাকা!
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কমিটি (BPICC) এর তথ্য অনুযায়ী, একদিনের বাচ্চা ২৭২ কোটি, ফিড ইন্ডাস্ট্রি ১১১ কোটি, ডিম ও মুরগীর মাংস উৎপাদন খামারির ৮৬৮ কোটি, প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান ৫ কোটি এবং ওষুধ বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে প্রথম এক মাসেই। ধারনার চেয়ে বেশী দীর্ঘায়িত হয় করোনার প্রকোপ, আজ এই জুনের প্রথম সপ্তাহেও তেতে আছে করোনার তাপ, প্রায় ১২০ দিন পর্যন্ত দৌড়ের উপর বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প। একটি ডিমের গড় উৎপাদন খরচ নূন্যতম ৬.৫০ টাকা এবং খামার পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের গড় বিক্রয় মূল্য ছিল ৪.৫০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ডিমে নীট ক্ষতি নূন্যতম ক্ষতি ২.০০ টাকা। সারা দেশে প্রতিদিন ৪ কোটি ডিম উৎপাদিত হলে শুধু লেয়ার খামারীগন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে দিনে প্রায় ৮ কোটি টাকা অর্থাৎ এই ১২০ দিনে করোনায় শুধু লেয়ার খামারী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে প্রায় ২৪০ কোটি টাকা।
দিনে ব্রয়লার মাংসের উৎপাদন হয় প্রায় ৫০০০ টন, যা প্রায় ৭০ দিন বিক্রয় হয়েছে কেজিতে গড়ে ৩০ টাকা অর্থাৎ টনে ৩০০০০ টাকা ক্ষতিতে। প্রতিদিন ব্রয়লার খামারীদের ক্ষতি প্রায় ১৫ কোটি টাকা এবং আজতক ক্ষতি প্রায় ১,০৫০ কোটি টাকা। বিগত প্রায় ১০০ দিনই হ্যাচারীগুলি এক দিনের বাচ্চা বিক্রয় করেছে প্রতিটি ১-৫ টাকায়। একটি বাচ্চার গড় উৎপাদন খরচ ৩৫ টাকা হলে প্রতিটি বাচ্চায় ক্ষতি হয়েছে ৩০ টাকা। দিনে ৩০ লক্ষ বাচ্চা উৎপাদিত হলে এই সেক্টরে প্রতিদিনের ক্ষতি ৯ কোটি টাকা অর্থাৎ এই ১০০ দিনে ক্ষতি প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। ফিডশিল্পের ভেটেরিনারী ঔষধ এবং আনুসাংগিক সহযোগী শিল্পের মোট ক্ষতি প্রায় ৫০০০-৬০০০ কোটি টাকা। জ্ঞান পাপীদের ষড়যন্ত্র ও গুজব - ব্রয়লার মাংস এবং ডিমের সাথে করোনা ভাইরাসের অযৌক্তিক ও কাল্পনিক সম্পর্ক স্থাপনে হুমকির মুখে পোল্ট্রি শিল্প। ভোক্তারা তার প্রিয় খাদ্য ব্রয়লার এবং ডিম থেকে হচ্ছে বঞ্চিত, অন্যদিকে খামারি ও সংশ্লিষ্টরা দেখছেন ক্ষতির মুখ। করোনা ভাইরাসের মোকাবেলা করতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ সৃষ্টি করা এবং পরিচ্ছন্নতা একমাত্র উপায়। তথাকথিত লকডাউনে প্রথম ধাক্কা খায় এই খাত।
ব্রয়লার মাংসের এক বড় অংশ হচ্ছে হোটেল, রেঁস্তোরা, ফাস্টফুডের দোকান, যা লকডাউনে বন্ধ হয়ে যায় অথবা ভোক্তা অভাবে সীমিত কার্যক্রম পরিচালনা করে। বিক্রি করতে না পারায় এবং বয়লার পচনশীল বলে স্থানীয় পর্যায়ে অতি অল্প মূল্যে এবং বিরাট ক্ষতিতে বিক্রি করতে হয়। হোটেল এবং রেঁস্তোরার পাশাপাশি ডিমের একটি বড় ভোক্তা হচ্ছে অফিসের কর্মচারী-কর্মকর্তা এবং রিকশাচালকের মত খেঁটে খাওয়া মানুষ। লকডাউনে ভোক্তা হারায় পোল্ট্রি শিল্প। একদিনের বাচ্চা উৎপাদনকারী হ্যাচারী বাচ্চা বিক্রি করতে না পেরে তা ধ্বংস করেছে, ক্ষতিগ্রস্ত খামারি টাকার অভাবে তার খামারে প্রয়োজনীয় ফিড দিতে পারে নাই। ফলে খামারের মুরগী দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং তাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে। অন্যদিকে ফিড মিলগুলো উৎপাদিত ফিড বিক্রি করতে না পেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে।
লকডাউনের জন্য উৎপাদিত ডিম, মাংস পরিবহন এবং কর্মরত কর্মচারী কর্মকর্তাদের ঘরে থাকার সরকারি আদেশে পুরো উৎপাদন ও সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়েছে। লকডাউন অথবা ছুটির শুরুতে সাধারণ ভোক্তা দীর্ঘকালীন ঘরে থাকার উদ্দেশ্যে বেশি ব্রয়লার মাংস এবং ডিম সংরক্ষণ করেছে। ফলে ঐ সময়ে ডিমের মূল্য বৃদ্ধি পায়। আগেই সাবধানবানী উচ্চারিত হয়েছিল, যদি লকডাউন দীর্ঘায়িত হয় অথবা লকডাউন পরবর্তীতে পুনরায় ব্রয়লার এবং ডিম ক্রয় করার প্রয়োজন হলে ঘটবে নতুন বিড়ম্বনা, মাংস ও ডিম উভয়ের স্বল্প সরবরাহ থাকবে।
পয়সা দিলেও এসব পণ্য মিলবে না, কারণ খামারি তার মুরগি বিক্রি করে দিয়েছে লোকসান হলেও এবং নতুন করে বাচ্চা ওঠায় নাই বলে বাজারে চাহিদার তুলনায় যোগানের ঘাটতি ঘটে এবং অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে ব্রয়লারের মূল্য বৃদ্ধি হয়ে খামারীর উৎপাদন খরচের সমান হয়েছে। লোকসানে থাকা খামারি খুব তাড়াতাড়ি খামারে আসবে না, হ্যাচারির বাচ্চা সরবরাহ বিঘিœত হবে।
মনে রাখতে হবে-পোল্ট্রি বিল্ডিং তৈরির মত কাজ নয় যে, ৫০ জনের জায়গায় ১০০ লোক দিয়ে ৩০ দিনের বদলে ১৫ দিনে করা যাবে। এ শিল্প থেকে উৎপাদন পেতে নির্দিষ্ট সময় প্রয়োজন। করোনা আতংকে ঘরে থাকা অবস্থায় ভোক্তার সঞ্চয়ে হাত পড়বে। ফলে, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ঘটতে পারে। আপদকালীন মিতব্যয়িতাও মাংস এবং ডিমের চাহিদা কমিয়ে দিতে পারে। বিশেষতঃ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ভোক্তার ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন ঘটবে বেশী। পোল্ট্রি শিল্পের এই ক্রান্তিকালে সরকারের আর্থিক এবং অন্যান্য প্রণোদনা প্রয়োজন খুব বেশী। উল্লেখ্য, অদ্যাবধি কখনই এ শিল্প ভর্তুকী দাবি করে নাই। কিন্তু এখন এই ভর্তূকী সময়ের দাবি। যে ক্ষতিসাধন হয়েছে তা শুধু ঋন দিয়ে পূরন হবার নয়, চাই ভর্তূকী। বিভিন্ন পণ্যের শূল্কমুক্তি, ব্যাংকঋণের কিস্তিসহ অন্যান্য চাপ অন্তত ছয় মাসের জন্য স্থগিত, বিগত ছয় মাসের ঋণ মওকুফ, স্বল্পসুদে নতুন ঋণ প্রদান জরুরি।
এছাড়া, চট্টগ্রাম বন্দরে দ্রুত পণ্য খালাসের উদ্দেশ্যে প্রতিটি চালান পরীক্ষার পরিবর্তে দৈব-চয়ন পদ্ধতিতে চালানের নমুনা পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করা উচিৎ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সহ প্রায় সকল আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে খুব সহসা মুক্তি নেই করোনা ভাইরাস থেকে বরং এই অদৃশ্য শত্রুর সাথেই হয়ত বাস করতে হবে বহুদিন। তাই কৌশল তৈরী করতে হবে যেন ভবিষ্যত সুসংহত হয় করোনাকে সাথে নিয়েই। আর এ জন্য প্রয়োজন সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ের সহাবস্থান। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মহাদুর্যোগ অবশ্যম্ভাবী, এ ব্যাপারে সহমত বিশ্বের বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদগন এবং প্রতিটি দেশ নিজ নিজ ক্ষেত্রে কৃষিকে প্রাধান্য দিয়ে অর্থনৈতিক পরিপত্র তৈরী করছে। কৃষিপ্রধান এই দেশে শুধু শষ্য কৃষি নয় বরং সম্পূর্ন কৃষি অর্থাৎ শষ্য কৃষি, প্রাণিসম্পদ, মৎসসম্পদ এবং বনসম্পদের উন্নয়নের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যৎ মুক্তির পথ।